অমরত্বের যাত্রা

অমরত্বের যাত্রা

অমরত্বের যাত্রা

মাইকেল আলাপ কক্ষে প্রবেশ করার পর পরই তার দুই বন্ধূকে অভিবাদন জানাল। রাজিব এর উত্তর দিল। পক্ষান্তরে রাশেদ এই বলে জবাব দিলঃ

তোমরা আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর, তোমাদের জন্য শক্ত প্রমান তৈরি করছি,

তোমরা কি লিভার্নো টীমের খেলোয়াড় মরিসিনিকে ইটালি লীগে পেস্কার ক্লাবের ম্যাচে পড়ে যেতে দেখেছ? স্টেডিয়ামের মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর হৃদযন্ত্র থেমে গেলে তিনি মারা যান। দর্শকরা হতচকিত হয়ে দেখছিলেন তার মুমূর্ষ অবস্থা, মুহুর্ত আগের অগ্নিঝরা উদ্যম মানুষটির হৃদযন্ত্র থেমে গেল।

মাইকেলঃ তবে এ ঘটনা থেকেও বেশি আশচর্যজনক হল, এফ এ কাপে টটেনহ্যামের সাথে মচে বল্টন টীমের খেলোয়াড় মুয়াম্বার পড়ে যাওয়া। হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়ায় খেলোয়াড়টি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। সবাই নিশ্চিত হলো যে, সে মারা গিয়েছে; কিন্তু এক বিরল অবস্থায় তার হৃদযন্ত্র ৭৮ মিনিট বন্ধ থাকার পর পুনঃ কাজ করতে লাগল । ডাক্তারগন এটাকে ৭৮ মিনিটের মৃত্যু বলে মনে করেছেন। তাই টীমের ডাক্তার টবেন আশ্চর্য হয়ে বিবৃতি দিলেন, “ব্যপারটা অবিশ্বাস্য আমরা ধারনা করতে পারছিলামনা যে মুয়াম্বা এ ভাবে সুস্থ হয়ে যাবে”, মুয়াম্বা মরে গিয়েও আবার জীবনে ফিরে এল!

রাশেদঃ মৃত্যু একমাত্র সত্য, যা সব মানুষ স্বীকার করে ও মানে, কিন্তু, মৃত্যুর পরে কি? মৃত্যুই কি শেষ? নাকি এর পর আরো কিছুর সুচনা আছে পরকালে, যেমন অনেক মানুষ বিশ্বাস করে?

রাজীবঃ পরকালের বিশ্বাস এমন একটি মৌল বিশ্বাস,যা মানুষ তার সৃষ্টি ও পৃথিবীতে বসবাসের সুচনা থেকে ধারন করে চলছে। অনেক প্রত্নতত্ব ও ঐতিহাসিক সাক্ষী প্রমান করে যে, এ বিশ্বাস বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার মাঝে বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন মিশরিয় , মায়া উপজাতি , রোমান ও মেসোপটেমিয়রাও এ বিশ্বাসের কথা জানত। আসমানি কোন ধর্মতো এ বিশ্বাস মুক্ত ছিলনা উপরন্তু ব্রহ্ম, বৌদ্ধ কনফুশিয়া, জরাদস্তিয়া ও সাবিয়ার মত মানব রচিত ধর্মগুলোতেও এ বিশ্বাস ছিল।

রাশেদঃ তোমার কথা ঠিক, এ বিশ্বাসের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছেন ইসলামের রাসুল (সঃ), যেভাবে সব নবী রাসুল তা উপস্থাপন করেছন মানুষের সামনে। এ বিশ্বাসের প্রতি ঈমান আনা সর্ব যুগে ইসলামের অন্যতম শর্ত। কারন এ বিশ্বাস ছাড়া আল্লাহ এবং তার কিতাব সমূহ ও রাসুল গণের প্রতি ঈমান আনার কোন অর্থ নেই।

মাইকেলঃ কিন্তু এ বিশ্বাসের প্রভাব তো মানুষের জীবনে সমান নয়। যেমন কম মানুষই তার চেতনা ও আচরণে তা উপলব্ধি করে।

রাশেদঃ এটা ঠিক, কারণ সবাই তা তাত্বিক ভাবে মানে কিন্তু অল্প মানুষই তা বাস্তবে রূপায়িত করে। এর প্রমান হল, আমরা ধরে নিলাম যে, যুদ্ধের সময় আকাশ আক্রমণের সাইরেন বেজে উঠল, তখন স্বাভাবিক ও সম্ভাব্য হল সড়কগুলো পথচারী ও যান চলাচল থেকে খালি হয়ে যাওয়া। যে এর বিপরীত করবে তাকে পাগল ও নির্বোধ মনে করা হবে। দুনিয়ার একটি ছোট্ট ব্যপারে যদি এমন হয় তাহলে এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারে আমাদের কেমন হওয়া উচিত? এমন ব্যপার যা মানুষ বিশ্বাস করে যে তা অবশ্যই ঘটবে, এর ব্যাপারে সতর্ক করেছেন স্বয়ং এ জগতের সৃষ্টিকর্তা। সব রাসুলের ভাষায় এর ঘোষনা দিয়েছেন। যৌক্তিক হল আল্লার এ সাইরেনের প্রতি মানুষের সাড়া আরো অধিক বড় আকারে ও মজবুতভাবে হওয়া।

মাইকেলঃ আমি মনে করি, এর কারন হল, যে বিপদের ব্যপারে সতর্ক সাইরেন বাজানো হয়, মানুষ তা দেখে ও শোনে। এমন কি তারা বাস্তবে এর মুখোমুখী না হলেও আরো বিভিন্ন অবস্থায় অথবা স্থানে তারা তা প্রত্যক্ষ করেছে কখনো এর নানা আলামত স্বচক্ষে দেখে থাকে। পক্ষান্তরে পরকাল ও আমাদের মাঝে মৃত্যু আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেনা। আর এটাই দুই অবস্থার মাঝে বিশ্বাসের পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।

রাশেদঃ তোমার কথা ঠিক, তবে ধরে নেওয়া যাক যে মানুষ যেহেতু তত্ব ও এর নিশ্চয়তা শুধু অনুধাবন শক্তি দিয়েই অর্জন করেনা বরং বিবেক দিয়ে। তাদের কাছে বিশ্বাসের দুর্বলতার কারণ তারা অন্তর চোখ দিয়ে দেখেনা। সুতরাং তারা যদি ব্যপারটা গভীর দৃষ্টিতে দেখত এবং চিন্তা করত তাহলে অনুধাবন করতে পারত যে, তারা চোখে যা দেখছে তা তাদের দৃষ্টির অগোচরের বিষয় থেকে বেশি নিশ্চিত নয়।

তাছাড়া এমন কিছু বিষয় আছে যা দেখা কিংবা অভিজ্ঞতা অর্জনের অপেক্ষা করা মানুষের জন্য ধংস ডেকে আনে। কারণ সেগুলো শুধু একবারই এসে থাকে। যেমন কেউ কাউকে এই বলে চ্যালেঞ্জ করল যে, সে একটি উঁচু ইমারতের উপর থেকে নিজেকে নিক্ষেপ করতে পারবে কোন আঘাত ছাড়া, আর অপরজন বলল, তাহলে দেখা যাক। তখন তা হবে প্রথম ও শেষ অভিজ্ঞতা এবং এ ব্যক্তির অবসান। ফলে এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ দাবীর সত্যতা যাচাই করা চলবেনা। বরং চিরাচরিত নিয়ম ও সমতুল্য অন্যান্য বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে সম্ভাব্য ফলাফলে পৌঁছতে হবে।

রাজীবঃ তাই আমাদেরকে এ আস্থা অর্জনের জন্য এ বিশ্বাস প্রমান করতে হবে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টান্ত দিয়ে।

রাশেদঃ এতে কোন আপত্তি নাই। তবে আমি বলতে চাই, এর চেয়ে বড় প্রমান হল, এ সংবাদ দাতার প্রতি আস্থা। আর তিনি হলেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি সংবাদ দিয়েছেন তার রাসুলদের মারফতে। এটাই হল তার প্রতি ঈমানের দাবি।কারণ আল্লাহ তায়ালা আমাদের চেয়ে বেশি জানেন এবং কি আমাদের জন্য উপকারী ও উপযুক্ত হবে এ ব্যপারে বেশি যত্নশীল।

আর তুমি যে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক প্রমান চেয়েছ তা অনেক। নীচে কিছু উল্লেখ করছি।

প্রথম প্রমানঃ সুচনার মাধ্যমে পূনরুত্থান সাব্যস্ত করা। এর মানে হল, আমরা যদি মানি যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তাহলে যিনি আমাদেরকে অনস্তিত্ব থেকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন মৃত্যুর পর তিনি আবার আমাদেরকে জীবীত করতে সক্ষম। বরং পুনর্জীবনের সম্ভাবনা যৌক্তিক ভাবে প্রথম জীবনের চেয়ে বেশি মজবুত।

দ্বিতীইয় যুক্তিঃ পদার্থ ও উপকরণ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় এবং এক স্বত্বা থেকে অন্য স্বত্বায় রূপান্তরিত হওয়া। আল কোরআন এর এমনসব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে, সবাই যার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম। যেমন, সবুজ বৃক্ষ থেকে অগ্নি নির্গত করা। সুতরাং যিনি কোন পদার্থকে তার বিপরীত পদার্থ থেকে তৈরি করেন, সৃষ্টির সব পদার্থ যার অনুগত, তাঁর পক্ষে পুরনো হাড়কে পুনরুজ্জীবিত করা মোটেও কঠিন নয়।

তৃতীয় যুক্তিঃ সৃষ্ট জগতের বিবর্তন। মৃত্যু, তারপর জীবন অতপর আবার মৃত্যু, তারপর জীবন। যেমন, শুকনো জমাট দানা থেকে গজায় তাজা সবুজ চারা, ফুল ফুটে, ফল দেয়। এর পর এ তাজা চারা জমাট দানা ফলায়। আর জীবন্ত বর্ধনশীল পাখী থেকে আসে জড় ডিম, এর পর এ ডিম থেকে আবার হয় জীবন্ত সচল পাখী। সুতরাং আমরা যা জড় ও মৃত মনে করি তাতেও প্রান লুকিয়ে থাকে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীও ঠিক তেমন।

চতুর্থ যুক্তিঃ মানুষ, প্রানী ও গাছের প্রানের মাঝে লক্ষণীয় পুনরুত্থান । যেমন মানুষের স্বাভাবিক দেহ গঠিত ২৬০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি কোষে। প্রতি সেকেন্ডে তা বিবর্তিত হয়, দ্রুত সংকোচিত হয়। খাবার এ সংকোচনের ঘাটতি পুরন করে। সুতরাং মানব দেহ বিরামহীনভাবে নিজেই নিজের বিবর্তন ঘটায় প্রবাহিত নদীর মত। এ ভাবে আমাদের দেহ একটি চলমান বিবর্তনের অধীন। এক পর্যায়ে এমন একটি সময় আসে যখন দেহে পুরাতন কোন কোষ থাকেনা। এ বিবর্তনতটি কৈশোর ও যৌবনে দ্রুত ঘটে থাকে, আর প্রৌঢ়ত্বে ঘটে ধীরে। গড়ে তা দশ বছরে এক বার ঘটে।

এ থেকে বুঝতে পারি যে, বাহ্যিক জড় দেহের বিবর্তন চলমান। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ভাবে মানুষ অপরবর্তিত। তার জ্ঞান, অভ্যাস, স্মৃতি শক্তি, আশা ও চিন্তা আগের মতই থাকে। যদি দেহ বিনাশের কারণে মানুষ বিনাশ হয়ে যেত তাহলে কোষগুলো বিনাশ হওয়া এবং সেগুলোর পূর্ণ বিবর্তনের কারণে অবশ্যই সে প্রভাবিত হত । এর মাধ্যমে পরিষ্কার হল যে, মানুষের জীবন এক জিনিস, আর দেহ আরেক জিনিস। দেহের কোষগুলো বিরামহীনভাবে বিনাশ হওয়ার মাধ্যমে দেহের বিবর্তন সত্বেও জীবন থেকে যায়।।

পঞ্চম যুক্তিঃ আধুনিক বিজ্ঞানে ইঙ্গিত মেলে যে জগতের উপকরণাদিমানুষের সব কর্ম পূর্ণভাবে সংরক্ষণ করে। আখেরাতের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল, দুনিয়ার ভাল মন্দ সব কাজের প্রতিদান দেওয়া। তা হবে সংরক্ষিত আমল মোতাবেক। আর আমলের মধ্যে শামিল হল নিয়ত, কথা ও কাজ। বিজ্ঞান প্রমান করে যে, উল্লেখিত তিনটি বিষয় নিঃশেষ হয়ে যায়না। বরং শেষ হওয়ার পরও সেগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

যে সব চিন্তা ও ইচ্ছা আমাদের মনে উদয় হয়ে আমরা তা ভুলে যাই, ঘুমের ঘোরে আমরা ওসব দেখি, কিংবা হিস্ট্রেরিয়ায় আক্রান্ত হলে অথবা উম্মাদ অবস্থায় অজান্তেই আমরা ওসব মুখে আওড়াতে থাকি। তা প্রমান করে যে, আমরা আকল বলে যা জানি ও অনুভব করি সেটাই শুধু আকল নয়। সেখানে আরো আছে এমন কিছু দিক যা আমরা অনুভব করিনা। তা হল, একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বত্তা। আর বিজ্ঞান প্রমান করেছে যে, তা আমরা মুছে ফেলতে পারিনা।

পক্ষান্তরে আধুনিক বিজ্ঞান যে বলছে, আমরা যে শব্দ শুনি তা হল বাতাসে নিহিত তরঙ্গপুঞ্জ। অকাট্য ভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, এ তরঙ্গপুঞ্জ প্রথমবার সৃষ্টি হওয়ার পর ইথারে থেকে যায়। কয়েক শতাব্দী পরেও তা পুনরায় শোনা সম্ভব। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারেনি। তা প্রমান করে যে, মানুষের সকল কথাই সংরক্ষিত থাকে।

আর আমল বিস্ময়কর ভাবে পরকাল সংঘটনের সম্ভাবনা প্রমান করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, আলো ও আঁধারে আমাদের সব সঞ্চালন ও কাজ ছবি আকারে মহাশূন্যে বিদ্যমান আছে। যে কোন সময় এসব ছবি সংকলিত করা সম্ভব। কারণ দেহ জড় হোক কিম্বা সচল হোক অবিরাম তা থেকে তাপ নির্গত হতে থাকে। তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহের আকৃতি ও মাত্রা প্রতিবিম্বিত করে। সদ্য কিছু সুক্ষ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে দেহ থেকে নির্গত তাপের স্পন্দন চিত্রায়িত করার। কিন্তু এ যন্ত্রগুলো তাপ স্পন্দন ঘটে যাওয়ার অল্প সময়ের মাঝেই শুধু চিত্রায়িত করতে পারে।

মাইকেলঃ আমরা পরকাল সংঘটনের আবশ্যকতা মানা ও ইসলামে এর গুরুত্ব বুঝার পর প্রশ্ন হল, ইসলামে এ বিশ্বাসের ধরণ কি?

রাশেদঃ ইসলামে এ আকীদার ব্যাখ্যা অন্য অধিকাংশ ধর্মে যা এসেছে তা থেকে অনেক ভিন্ন। তবে সাধারণভাবে এ আকীদা সংক্ষেপে নিন্মরূপঃ

১- আল্লাহ তায়ালা এক দিন এ বিশ্ব এবং এতে যত সৃষ্টি আছে সব মুছে দিবেন, একেই কেয়ামত দিবস বলে।

২- এর পর তিনি তাদেরকে পুনরায় জীবিত করে তার সামনে জমা করবেন। আর তাই হল হাশর বা পুনরুত্থান।

৩- এর পর মানুষ দুনিয়ার জীবনে ভাল মন্দ যা করেছে এর সব আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে। এতে কোন বেশ কম হবেনা।

৪- আল্লাহ সবার ভাল ও মন্দ আমল পরিমাপ করবেন। তখন যার ভাল আমলের পাল্লা ভারি হবে তাকে ক্ষমা করবেন। আর যার মন্দ আমলের পাল্লা ভিরি হবে তাকে শাস্তি দিবেন।

৫- যাদেরকে ক্ষমা করবেন তারা জান্নাতে যাবে আর যাদেরকে শাস্তি দিবেন তারা জাহান্নামে যাবে।

রাজীবঃ আসলে বিষয়টা চরম ঝুকির।




Tags: